লাইফ ইন্স্যুরেন্স নিয়ে ৭ টি প্রচলিত ভুল ধারণা
আমাদের মাঝে বেশিরভাগ মানুষই মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা ভাবার মতো অপ্রীতিকর কিছু আর হতেই পারে না। ঠিক সে কারণেই বেশির ভাগ মানুষেরই জীবন বীমা সম্পর্কে জানতে অথবা একজন ইন্স্যুরেন্স এজেন্টের সাথে কথা বলতে বেশ অনীহা থাকে।
আমাদের সমাজে জীবন বীমা নিয়ে নানারকম ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যেগুলো আজও ভাঙ্গেনি অথবা বলা যায় সঠিক উপায়ে আমাদের কাছে তুলে ধরা হয় নি। একটি জীবন বীমা আমাদের জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে কিন্তু তারপরও আমরা ‘জীবন বীমা’ এমনকি ‘বীমা’ শব্দটি শুনলেই দূরে থাকি।
চলুন দেখি, জীবন বীমা নিয়ে আমাদের মাঝে সবচেয়ে প্রচলিত ৭ টি ভুল ধারণাঃ
১। লাইফ ইন্স্যুরেন্স মানে হল একমাত্র মৃত্যুতেই ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়া যাবে
যখন আমরা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কথা ভাবি, বেশির ভাগ সময় এটাই মনে করি যে একমাত্র ইন্স্যুরেন্স করা ব্যক্তির মৃত্যুতেই দাবীর টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় শুধু এরকমরটাই নয়। আমাদের দেশে যে কোন একটি সঞ্চয়ী বীমা কিনার সাথে সাথে অন্যান্য আরো অনেক সহযোগী বীমা (রাইডার) নিয়ে নেয়া যায় যেগুলো বীমা চলাকালীন সময়ে নানা রকম বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকে। এটা হতে পারে চিকিৎসা সংক্রান্ত, হতে পারে পঙ্গুত্ব অথবা কোন জটিল ব্যাধির ব্যয় বহুল চিকিৎসা সম্বন্ধনীয়। তাছাড়া শিশুর শিক্ষা গ্রহণকালীন আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন রকম শিক্ষা বীমা বা শিশু সুরক্ষা বীমা। পাশাপাশি বিভিন্ন রকম স্টেজ পরিকল্প রয়েছে যেগুলো বীমা চলাকালীন সময়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বীমার অর্থ গ্রাহককে পরিশোধ করে থাকে যা দিয়ে একজন গ্রাহক অন্তর্বতীকালীন বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। সুতরাং বীমা যে শুধুমাত্র মৃত্যুতেই বীমার অর্থ প্রদান করে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় বরং বীমা চলাকালীনও একজন গ্রাহক বিভিন্ন রকম আকর্ষণীয় সুবিধা পেতে পারেন যা তার আপদকালীন আর্থিক প্রয়োজনীয়তা মিটাবে বা ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
২। আমার বয়স তো অনেক কম, আমার লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রয়োজন নেই
জীবন বীমা পলিসি নেয়ার নির্ধারিত কোন বয়স নেই। তবে বিভিন্ন কোম্পানি ও পলিসির ধরণ অনুযায়ী একটি সর্বোচ্চ বয়স সীমা দেয়া থাকে যার বেশি বয়স হলে কেউ পলিসি কিনতে পারে না। সাধারণত ২৫-৪৫ বছর বয়সী ৫০ শতাংশেরও বেশি কর্মজীবী মানুষের অশাল মৃত্যুতে অথবা শারীরিক অক্ষমতাজনিত কারণে তাদের পরিবার অনাকাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একটি জীবন বীমা সেই পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও মানসিক শান্তি নিশ্চিত করতে পারতো। পাশাপাশি তরুণ বয়সে আপনি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম বাবদ একটি বড় অংকের অর্থ সঞ্চয়ও করতে পারছেন। আর যত কম বয়সে বীমা করা যায় প্রকৃত অর্থ ততোই ভাল কারণ বয়স কম থাকলে একই পরিমাণ বীমা অংকের জন্য বেশি বয়সী একজন লোক থেকে কম বয়সী একজন লোকের তুলনামূলক অনেক কম প্রিমিয়াম আসে।
৩। আমি তো বিয়েই করিনি, লাইফ ইন্স্যুরেন্স দিয়ে আমি কি করবে?
ট্র্যাজিক ঘটনা যে কারো জীবনেই ঘটতে পারে, হোক সে অবিবাহিত কিংবা বিবাহিত কিংবা সন্তানবিহীন। যে কেউই জীবন বীমা থেকে উপকৃত হতে পারেন। এমনকি অবিবাহিত মানুষরা বিশাল অংকের ঋণ অপরিশোধিত রেখে বিদায় নিতে পারেন, যা তার পরিবার বীমা দাবীর অর্থের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারেন।
৪। আমার শারীরিক কোন সমস্যা নেই, আমার জীবন বীমার প্রয়োজন নেই
হতে পারেন আপনি সুস্থ, তবে তা জীবন বীমা না করার জন্য কোন অজুহাত হতে পারে না। এ ব্যাপারে অনেকেই একমত হবেন যে, অসুস্থতার ক্ষেত্রে অসুস্থ্য অবস্থায় আমরা হয়তো মৃত্যু চিন্তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি করে থাকি। এজন্য আমরা বীমার প্রয়োজনীয়তাটাও বেশি মাত্রায় অনুভব করি। আর প্রকৃতপক্ষে সুস্থ অবস্থায়ই বীমা করতে হয় এবং অসুস্থ হলে যাতে তার সুবিধা ভোগ করা যায়। কারণ অসুস্থ কোন ব্যক্তির বীমা কোন কোম্পানিই করবে না। তাই সুস্থ অবস্থাই বীমা করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
৫। আমার অফিসে গ্রুপ বীমা করা আছে, আর কোন বীমার প্রয়োজন নেই
সাধারণত কোম্পানি প্রদত্ত বীমাগুলোতে বাৎসরিক বেতনের দুই-তিন গুণ বেশি মৃত্যুদাবী দেয়া হয়ে থাকে যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যথেষ্ঠ নয়। তাছাড়া গ্রুপ বীমা হচ্ছে এক ধরণের মেয়াদী বীমা যেখানে সঞ্চয়ের কোন সুযোগ থাকে না। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন এবং আর্থিক সামর্থে ও অনেক প্রভেদ বিদ্যমান। ফলে গ্রুপ বীমা যা সকল কর্মীদের কথা বিবেচনা করে করা হয় তা প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তা মিটাতে স্বাভাবিকভাবেই অক্ষম। এজন্য প্রয়োজন মাফিক অন্যান্য সঞ্চয়ী বীমা বা টার্ম লাইফ ইন্স্যুরেন্স (বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রচলিত একমাত্র টার্ম লাইফ – ইজিলাইফ) হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী সমাধান।
৬। সব বীমা কোম্পানিই প্রতারক
আমাদের সমাজে প্রচলিত এটি আরেকটি প্রচলিত ধারণা। এর জন্য প্রধানত দায়ী কিছু অসাধু বীমা কোম্পানি এবং কর্মকর্তা বৃন্দ যার ফল বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ভালো কাজ করা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকেও। কিন্তু বাজারে অনেক ভাল বীমা কোম্পানিও আছে। আপনি খুব সহজেই বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই করে নিতে পারেন যে কোন বীমা কোম্পানি। আমাদের দেশীয় বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যেও অনেক ভাল কোম্পানি আছে। তাছাড়া আপনি বীমা কোম্পানিগুলোর স্ব স্ব ওয়েবসাইট, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট, বিভিন্ন পত্রিকার খবর এবং কোম্পানিগুলোর আর্থিক বিবরণী পর্যবেক্ষণ করেও আপনি সঠিক বীমা কোম্পানিগুলোর সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। এপেক্স, ব্র্যাক ও স্কয়ার এর মত স্বনামধন্য তিনটি কোম্পানির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সফল বীমা কোম্পানি। আপনি চাইলে এখান থেকেও আপনার পছন্দ মত বীমা করাতে পারেন।
৭। জীবন বীমা অনেক খরুচে (দামী)
বীমা সম্পর্কিত ভুল ধারণাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। আমরা অনেকেই মনে করি প্রতিশ্রুতি সুরক্ষা অনুযায়ী জীবন বীমা অনেক বেশি খরুচে। তরুণদের মধ্যে এই ধারণাটা আরো বেশি প্রবল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে জীবন বীমা খুবই কাস্টমাইজ একটা সেবা যার খরচ নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আপনার হাতেই। আপনি চাইলেই যেমন অনেক খরুচে বীমা নিতে পারেন তেমনি অনেক সল্প খরচে অনেক মূল্যবান বীমাও নিতে পারেন। সাধারণত বেশি বয়সে সঞ্চয়ী বীমাগুলো নিতে গেলে খরচ একটু বেশি হয়। কিন্তু পাশাপাশি কম বয়সে (১৮-৪৫) বয়সের মধ্যে বীমা করলে আপনি তুলনামূলক অনেক কম খরচে বীমা করতে পারেন এবং অনেক কম খরচে হাই ভ্যালু লো কস্ট বীমাও কিনতে পারবেন। বাজারের এখন সবচেয়ে কম খরচে অনেক বেশি মূল্যমানের টার্ম লাইফ বীমা পলিসিও পাওয়া যায়। যেমন আপনি ইজিলাইফে বছরে সর্বনিম্ন ৩৬২ টাকায় ১ লক্ষ টাকার কাভারেজ পেতে পারেন। আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী খরুচে বা সল্প মূল্যের যে কোন বীমাই কিনতে পারেন।
ভুল ধারণা ছিল, থাকবে। শত বছরের পুরনো এসব ভুল ধারণা পাঁচ-দশ দিনে ভাঙ্গবে না। দিনশেষে জীবনটা আমার-আপনার। আমাদের অবর্তমানে আমাদের প্রিয়জনদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে যাওয়া আমাদেরই দায়িত্ব। আসুন বদলে ফেলি আমাদের ভুল ধারণাগুলো এবং আর্থিকভাবে সুরক্ষিত করি আমাদের পরিবারকে।